শুক্রবার । ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫ । ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
বিজয়ের স্মৃতিকথা

অবাঙালি সহকর্মীর বিশ্বাসঘাতকতার শিকার শহীদ সাংবাদিক আবু তালেব

কাজী মোতাহার রহমান

স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের খ্যাতিমান এক সাংবাদিক খোন্দকার আবু তালেব। ১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ ঢাকার মিরপুরে নিজের বাড়ির কাছেই শহিদ হন। একজন উর্দুভাষী অবাঙালি সহকর্মী আবদুল হালিমের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন তিনি। মিরপুরে পাকিস্তানি দোসররা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সাতক্ষীরা সদর থানার সাতানি গ্রামে ১৯২১ সালের ২৩ মার্চ জন্ম তাঁর। তাঁর বাবার নাম খোন্দকার আবদুর রউফ। মা রোকেয়া খাতুন। এগারো সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন তিনি। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় তাঁর দায়িত্বও ছিল বেশি। বাবা’র আয়-রোজগার ভালো ছিল না। সংসার চালাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। তিনি চাইতেন বড় সন্তান সংসারের দায়িত্ব কিছুটা গ্রহণ করুক, আয়-রোজগার করুক। ছেলে খুব বেশি লেখাপড়া করুক তা তিনি চাইতেন না। তবে মা চাইতেন, সন্তান লেখাপড়া করুক। মায়ের উৎসাহেই তিনি লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী হন।

১৯৪৪ সালে তিনি সাতক্ষীরা পিএন হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়, ভর্তি হন রিপন কলেজে।

১৯৪৬ সালে আইএ পাস করেন। দেশভাগের পর তিনি চলে আসেন ঢাকায়। এখানেও লেখাপড়ার পাশাপাশি চলে চাকরি। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিকম ডিগ্রি অর্জন করেন আর পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতা। পরে ১৯৫৬ সালে তিনি এলএলবি ডিগ্রিও নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আইনজীবী হিসেবে সনদও নিয়েছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কোনো না কোনো সময়। প্রথমে কাজ শুরু করেন দৈনিক আজাদে সহ-সম্পাদক হিসেবে। দীর্ঘ সময় কাজ করেন এই পত্রিকায়। পরে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। প্রায় পাঁচ বছর কাজ করেন সংবাদে সহ-সম্পাদক হিসেবে। এরপর যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে চিফ রিপোর্টার হিসেবে।

১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার দৈনিক ইত্তেফাক বন্ধ করে দিলে সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। দৈনিক আওয়াজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৬৯ সালে আবার দৈনিক ইত্তেফাকে ফিরে যেতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষ তাঁকে আর পুনর্বহাল করেনি।

স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসক চরের বিরুদ্ধে সকল আন্দোলনে তিনি ছিলেন নীরব কর্মী। ৬ দফার আন্দোলনেও এমনিভাবেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। ৬ দফা প্রণীত হয়েছিল ইংরেজিতে। তিনিই তা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন এবং প্রথম প্রকাশ করেছিলেন সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ পত্রিকায়। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইসতেহারের অনুবাদও করেছিলেন তিনি। বই পড়তে ভালোবাসতেন খুব।

খোন্দকার আবু তালেবের ঢাকার বাসস্থান ছিল মিরপুরে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী একটি বিশাল চক্রের বসতি ছিল মিরপুরে। সেখানে বেশির ভাগ বাসিন্দাই ছিল বিহারি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার আগে থেকেই মিরপুর এলাকার বিহারিরা স্থানীয় বাঙালিদের নানা হুমকি দিয়ে আসছিল। ১০ নম্বর সেকশনের এ ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ১ নম্বর বাড়িতে ছিল বিহারিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদারে মিল্লাত উর্দু মিডিয়াম স্কুল। পাকিস্তান সরকার ২৩ মার্চকে পাকিস্তান দিবস ঘোষণা করে। বিপরীতে ঐ দিনকে বাঙালিরা বাংলাদেশ দিবস ঘোষণা করে। এরই অংশ হিসেবে বাঙালিদের পক্ষ থেকে গোপনে মাদারে মিল্লাত উর্দু মিডিয়াম স্কুলে বাংলাদেশের পতাকা অর্ধ নমিত করে তোলা হয় এবং একই সঙ্গে কালো পতাকাও ওড়ে। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মিরপুরের বিহারিরা।

আতঙ্কে বাঙালিরা দলে দলে মিরপুর ছাড়তে থাকে। ২৪ মার্চ খোন্দকার আবু তালেবের পরিবারের সকলকে পাঠিয়ে দেন চামেলীবাগে তাঁর বোনের বাসায়। নিজে রয়ে যান মিরপুরে। উদ্দেশ্য পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখা। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং তাঁকে মিরপুরে থেকে সেখানের খবরা-খবর জানাতে বলেছেন। ২৫ মার্চ সকালে তিনি চামেলীবাগ যান বোনের বাসায়। মিরপুরের অবস্থা সকলকে জানান তিনি।

সেখানের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি তখন ছিলেন খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আরও খোঁজ খবর নিতে তিনি আবার ফিরে যেতে চান মিরপুরে। কিন্তু পরিবারের সকলের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত আপাতত মিরপুরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে মিরপুর থেকে চলে আসার পর থেকেই খোন্দকার আবু তালেবের স্ত্রী কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করছিলেন। বিহারিদের নিষ্ঠুরতা এবং ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। বিকেলে তিনি যান বন্ধু ও সহকর্মী দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের বাসায়। ফেরেন রাত ১০টার পর। বাসায় ফেরার এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। কানে আসতে থাকে স্বয়ংক্রিয় বিভিন্ন অস্ত্রের বিকট শব্দ। তাঁর বোনের বাসাটি ছিল পুলিশ লাইনের একেবারে পাশেই। মাঝখানে শুধু কাঁটাতারের বেড়া। তাই সবই ঘটছিল চোখের সামনে। সারা রাত চলে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ। সকালের দিকে গোলাগুলির শব্দ কিছুটা কমে আসে। বাসার লোকজন উঁকি দিয়ে দেখে বাড়ির চারিদিকে পুলিশের ফেলে যাওয়া রাইফেল, পিস্তল, রিভলবার, গুলি বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে আছে। ভীত হয়ে পড়েন বাড়ির লোকজন।

২৬ মার্চ সারা দিন সারা রাত পাশের বাড়ির একটি ঘরে গাদাগাদি করে কাটিয়ে দিতে হয় সকলকে। আতঙ্কে কেউ ঘরের বাইরে বের হতে সাহস করেননি। কারফিউ শিথিল হলে ২৭ মার্চ তিনি সকলকে নিয়ে ফিরে আসেন বোনের বাসায়। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী ইত্তেফাক ভবন বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়। তিনি সেখানে কয়েকটি পোড়া লাশ দেখতে পান। কিন্তু কাউকে চেনার উপায় ছিল না। মৃত এই সহকর্মীদের জন্য বুক ভারী হয়ে আসে তাঁর। বেদনাহত মন নিয়ে ফিরে আসেন তিনি।

মিরপুরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন খোন্দকার আবু তালেব। কোনো এক দুর্নিবার আকর্ষণে কিংবা নিয়তির অমোঘ টানে তিনি ২৯ মার্চ ছুটে যান মিরপুরে। আপনজনদের বাধা তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। বন্ধুদের নিষেধ তিনি শোনেননি।

বন্ধুদের তো সব সময়ই বলতেন, “আমার কিচ্ছু হবে না। ওরা আমাকে চেনে। আমি তো ওদের কোনো ক্ষতি করিনি।”

ঐদিনের ঘটনা সম্পর্কে খোন্দকার আবু তালেবের মেয়ে সখিনা খোন্দকার বলেন, “সেদিন ২৯ মার্চ, আব্বা যাচ্ছিলেন অফিসের দিকে। পথে ইত্তেফাকের অবাঙালি চিফ একাউন্ট্যান্ট আবদুল হালিমের সঙ্গে দেখা হয় আব্বার। হালিম তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে যান মিরপুরে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মিরপুর থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন জহির খান। আব্বা তাঁকে সমর্থন করেছিলেন। এ কারণে অবাঙালিদের আক্রোশ ছিল আব্বার ওপর। আমার আব্বার ক্ষত-বিক্ষত লাশ আমি আর দেখিনি। দেখতে চাইও নি। শুধু বুঝেছি, আমাদের এতিম করে দেওয়া হল। চির চেনা মিরপুর থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে যান সাংবাদিক খোন্দকার আবু তালেব। ভয়াবহ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে যান অপ্রকৃতিস্থ স্ত্রী রাবেয়া খাতুন এবং তিনটি শিশু সন্তানকে।”

একাত্তরে পুঁড়িয়ে দেওয়ার পর শহিদ এ সাংবাদিকের বাড়িটি অবাঙালিদের দখলে চলে যায়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাঁর পরিবার অনেক কষ্টে উদ্ধার করে মিরপুরের বাড়িটি। বাড়ি ফিরে পাওয়ার পরও দীর্ঘ সময় কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁর পরিবারকে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন